বঙ্গবন্ধুর মধ্যো এমন একটা ম্যাগনেটিক আকর্ষণ ছিল যে তিনি মানুষকে ধরে রাখতে পারতেন
“তিনি ছিলেন খুবই এক ক্যারিশম্যাটিক ব্যক্তিত্ব, দুর্দান্ত মানুষ।
বাংলার জমিন ডেস্ক :
আপলোড সময় :
১৫-০৮-২০২৩ ০৪:০৪:৩১ অপরাহ্ন
আপডেট সময় :
১৫-০৮-২০২৩ ০৪:০৪:৩১ অপরাহ্ন
এম,এ,কাশেম পাপ্পু,ব্যবস্থাপনাপরিচাক-নিপ্পন গ্রুপ,
অবসরপ্রাপ্ত এক বয়োজ্যেষ্ঠ মার্কিন কূটনীতিক চার্লস স্টুয়ার্ট কেনেডি যিনি এখন ভার্জিনিয়ায় অ্যাসোসিয়েশন ফর ডিপ্লোমেটিক স্টাডিজ অ্যান্ড ট্রেনিং-এর ফরেন অ্যাফেয়ার্স ওরাল হিস্ট্রি প্রকল্পের পরিচালক; তিনি ১৯৮৯ সালের ২০ অক্টোবর ৭৪-৭৬ সালে বাংলাদেশে কর্মরত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজেন বোস্টারের একটি সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারের সূত্র ধরে আজকের এই রচনা যেখানে রাষ্ট্রদূত বোস্টার বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন-
“তিনি ছিলেন খুবই এক ক্যারিশম্যাটিক ব্যক্তিত্ব, দুর্দান্ত মানুষ। আপনি কেবল এই ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে তাৎক্ষণিকভাবেই তাকে পছন্দ করবেন।”তাকে কত লোকে কত উপাদি দিতেন বা এখন ও দেন,তার মধ্যো এমন একটা ম্যাগনেটিক আকর্ষণ ছিল যে তিনি মানুষকে ধরে রাখতে পারতেন.
বঙ্গবন্ধুর জীবন-যাপন সম্পর্কেও বোস্টার উল্লেখ করেন তার সব প্রশংসনীয় মত-
“যে বাড়িটিতে তিনি থাকতেন সেটি ছিল খুব সাধারণ একটি বাড়ি, কোন একটি দেশের রাষ্ট্রপতির বসবাসের জন্যে যথাযথ নয়। কিন্তু তিনি দেশের পিতার মতো ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ছিলেন অনেকটা জর্জ ওয়াশিংটনের মতো, যিনি তার দেশকে স্বাধীনতার দিকে নিয়ে গেছেন তবে রাষ্ট্র পরিচালনার দক্ষতা তার তেমন ছিল না!” বোস্টারের মতে- “শেখ মুজিবের চেয়ে জিয়া প্রশাসক হিসেবে দক্ষ বলে বলে তার কাছে মনে হয়েছে ও সেরকম কাউকেই তখন দরকার ছিল।” (Someone with more managerial talent was required. They had that talent in Zia who eventually succeeded him)!
এই যে ‘মুখে এক মনে আর এক’ চরিত্রের তৎকালীন মার্কিন কূটনীতিক, বোস্টার হলেন তার এক নিকৃষ্টতম উদাহরণ। বঙ্গবন্ধুর সাথে তার শেষ সাক্ষাতে (৫ অগাস্ট ১৯৭৫) তারা দুজনই দেশ পরিচালনা, বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের সম্পর্ক, বঙ্গবন্ধুর ভাবনা ও দর্শন, রাষ্ট্রচিন্তা সবই আলোচিত হয়েছিল ও পরদিন রাষ্ট্রদূত বোস্টার যে তারবার্তায় এই সাক্ষাতের প্রতিবেদন ওয়াশিংটনে পাঠান সেখানে তিনি বঙ্গবন্ধুর এরকম প্রশংসা করে বিস্তর স্তুতিবাক্য লিখেছিলেন। কিন্তু তিনি প্রতিবেদনের ভাষা বিন্যাসে এই কথাও লিখতে ভোলেননি যে, বঙ্গবন্ধু তাকে তার রাষ্ট্রচিন্তার যে দর্শন ব্যাখ্যা করেছিলেন তাতে মার্কিন সরকারের বিচলিত হবার যথেষ্ট কারণ আছ-
“আমি মার্ক্সিস্ট নই। আমি একজন সমাজতান্ত্রিক কিন্তু সেটা আমার নিজস্ব পথে। আমি সব দেশের বন্ধু হতে চাই কিন্তু তার মানে এই নয় যে, কোন দেশ ভাবুক আমাকে কী করতে হবে সেটা সে বলে দেবে।” (I am not a Marxist. I am a Socialist, but a Socialist in my own way. I want to be friends with all countries but I don’t want any country to think it can tell me what to do) । এই প্রতিবেদনের শেষে সারমর্মে বোস্টার লিখেন- “His repetiation of the theme that he is not a Masrxist, his insistance thay no other power can tell him what to do, and his volunteered criticism of communist China’s farm system all seem intended to ease our minds about the political direction he is taking.”
বোস্টার স্বর্গরাজ্যে বাস করতেন তাই তার অভিজ্ঞ কর্মজীবনের অন্যান্য সাফল্য-ব্যার্থতার সঙ্গে গুলিয়ে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ভেবেছিলেন বড় দেশগুলোর মন জয় করতেই বুঝি তিনি এমন করে কথা বলেছেন। সেটা যে মোটেও নয়, বোস্টার তা জানতেন কিন্তু কূটনীতির ‘হিপোক্রেসির’ আড়ালে থেকে তিনি নিজেদের জন্যে উপযোগী কথা সাজিয়ে নিয়েছিলেন ও লিখেছিলেন। যদি তাই-ই হতো বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলার চক্রান্তে তাদের সায় থাকত? আর না থাকলে জিয়াকে কেন ভালো প্রশাসক মনে হয়েছিল তার?
জিয়া কি বঙ্গবন্ধুর সমকক্ষ ছিলেন? এখন যদি আমরা প্রশ্ন করি, বোস্টার কবে থেকে জিয়াকে চিনতেন বা জানতেন? এমন কোনো রাজনৈতিক ও উন্নয়ন দর্শন জিয়ার কি ছিল যা বাস্তবায়নে দক্ষতা দেখে বোস্টারের মনে হয়েছিল জিয়া বঙ্গবন্ধুর চেয়ে দক্ষ প্রশাসক? এসবই ছিল কুচক্রীদের আগে থেকে ঠিক করা, ঠিক বঙ্গবন্ধু হত্যার আগের ও পরের তারবার্তা মিলিয়ে দেখলেও পাওয়া যায় মার্কিননীতির মধ্যে বঙ্গবন্ধুবিরোধী নীতির প্রভাব কতটা প্রবল ছিল যা ১৯৭১ সালে কিসিঞ্জারের নীতির পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবার বাসনাকে তীব্র করেছিল। আর সে বাসনা চরিতার্থ করতে যুদ্ধকালীন থেকেই মার্কিন ফাঁদে পা দিয়েছিল বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুবিরোধী একদল অভিশপ্ত মানুষ।
পরের তথ্য অনুসন্ধানের বিশ্লেষণের আগে আমাদের জানা দরকার এই রাষ্ট্রদূত বোস্টার কে ছিলেন ও কী তার পেশাগত তৎপরতা ছিল। ডেভিড ইউজেন বোস্টারের জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের ওহায়ো অঙ্গরাজ্যে ১৯২০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর। প্রথম জীবনে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির ট্রেনিং সেন্টারের শিক্ষা অফিসার হিসেবে তিনি কাজ করতেন ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন নৌ-বাহিনীতে যোগ দেন। যুদ্ধের শেষে সিআইএ, পররাষ্ট্র দপ্তর ও নৌবাহিনীতে বেসামরিক চাকরির জন্যে আবেদন করেন ও তিনটি চাকরির জন্যেই নির্বাচিত হন। যদিও তিনি পররাষ্ট্র দপ্তরের কাজই বেছে নেন ও প্রথম পোস্টিং পান ১৯৪৭ সালে মস্কোতে পলিটিক্যাল অফিসার হিসেবে।
কালে কালে তিনি সদর দপ্তর হয়ে সমাজতান্ত্রিক বলয়ের পূর্ব জার্মানিতে কাজ করেন। ১৯৫৮ সালে ওয়াশিংটনে ফিরিয়ে এনে তাকে তখনকার স্টেট ডিপার্টমেন্টের সেক্রেটারি (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) জন ফসটার ডালাসের বিশেষ সহকারী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইজেনহাওয়ারের সে আমল ছিল সোভিয়েতবিরোধী স্নায়ুযুদ্ধের তুমুল বিতর্কের সময় যার অন্যতম সহযোগী ছিলেন এই বোস্টার। পরবর্তীকালে তিনি মেক্সিকো ও ল্যাটিন আমেরিকার একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে নাম করেছিলেন ও সমজাতান্ত্রিক বিশ্বের উত্থান ঠেকাতে মার্কিননীতির কট্টর অফিসার ছিলেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধের আনুপূর্বিক বিশ্লেষণে বোস্টার সদর দপ্তরকে প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন। পরে তিনি নেপাল ও পোল্যান্ডে কর্মরত ছিলেন।
নেপাল ছাড়া তার অন্যান্য সব নিয়োগে সদর দপ্তরের আকাঙ্ক্ষাই কাজ করেছে বেশি। ১৯৭৪ সালে তাকে জেনেভায় একটি নিয়োগ দেয়া হলেও বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত করা হচ্ছে এমন একটি কথা ছড়িয়ে পড়ে। জানুয়ারিতে বোস্টার ওয়াশিংটনে তার এক সহকর্মী ল্যারি ইগলবার্গারের সঙ্গে আলাপ করেন যিনি কিসিঞ্জারের খুব কাছের লোক ছিলেন। তিনি তাকে নিশ্চিত করেন যে, তিনি বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে যাচ্ছেন। সে নিয়োগের কথা শুনে বোস্টার একজন কর্মকর্তার কাছে নাকিস্বরে জানতে চান, সেখানে আর কোনো বিশেষ কাজ তার রয়েছে কিনা (I swallowed hard, grumbled and asked whether there was any other assignment)। আমাদের অনুসন্ধান করতে হবে এই কথা দিয়ে বোস্টার সেদিন কী বোঝাতে চেয়েছিলেন? আর কী উত্তর তিনি ওই কর্মকর্তার কাছ থেকে পেয়েছিলেন।
প্রশ্ন হলো পূর্ব ইউরোপ ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক বলয়ের এমন একজন তুখোড় ও অভিজ্ঞ কূটনীতিককে কিসিঞ্জার কেন বাংলাদেশের জন্যে নির্বাচিত করলেন? সেটা সহজেই অনুমেয়, বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত ও প্রবর্তিত কৃষক–শ্রমিক উন্নয়নের যে বাংলাদেশ তখন গঠিত হতে যাচ্ছিল তা থামাতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তাদের নিতেই হবে। এরকম একজন অভিজ্ঞ বা ঝানু কূটনীতিক ছাড়া যে এই দেশে তা সম্ভব নয়, সেটা খোদ কিসিঞ্জারও হয়তো উপলব্ধি করেছিলেন।
“গত ২৪ ঘণ্টার পরিস্থিতি দেখে এটা স্পষ্ট যে, পুলিশ, প্যারা মিলিটারি বাংলাদেশ রাইফেল ও রক্ষী বাহিনী সবাই এই ঘটনা মেনে নিয়েছে। সাধারণ মানুষ কোনো উল্লাস প্রকাশ না করলেও বোঝা যাচ্ছে তারা সব মেনে নিয়েছে ও স্বস্তিবোধ করছে। একই প্রতিবেদনে তিনি জানিয়েছেন-
“হত্যাকাণ্ড সংঘটনের সময় মুজিবের ভাগ্নে শেখ মণির বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিতেও পরিকল্পনাকারীরা সময় নিতে চায়নি।” তার মানে কি এই নয় যে, এসব খুঁটিনাটি সিদ্ধান্তের কথা বোস্টার জানতেন? না হলে সংঘটিত পরিস্থিতিতে হত্যাকারী বা পরিকল্পনাকারীদের মনের ভাবনা ও যুক্তি কী ছিল ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তিনিইবা জানলেন কেমন করে! হত্যাকারীরা তখনও এমন কোনো ঘোষণা দেয়নি যে তারা কেন বঙ্গবন্ধুর পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়স্বজনদের ও ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহকর্মীদের হত্যা করেছিল ও কী তাদের উদ্দেশ্য ছিল?
মোশতাকের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে তারা বঙ্গবন্ধু হত্যার কথাই ঘোষণা করছিল যদিও সারা বিশ্বের বিবেকবান মানুষদের না বোঝার কারণ ছিল না যে, বঙ্গবন্ধুর দর্শনের হত্যা করতে তার সহযোগীদেরও হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের পৈশাচিকতা থেকে এ-ও প্রমাণিত যে, এই ঘটনার পেছনে ছিল দীর্ঘদিনের পরিকল্পনা ও প্রতিশোধস্পৃহা। সে প্রতিশোধস্পৃহা ছিল একাধারে রাজনৈতিক-ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জনকারী দেশ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে, তার দিক-নির্দেশক নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ও সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গঠনের সবরকম উদ্যোগের বিরুদ্ধে।
৫ অগাস্ট বোস্টারের সঙ্গে শেষ সাক্ষাতে বঙ্গবন্ধু তার উন্নয়ন দর্শনের ব্যাখ্যা করতে যেয়ে যে সমবায় আয়োজনের কথা বলেছিলেন তাতে আমরা অনুমান করতে পারি বোস্টারের ভ্রু কুঞ্চিত হয়েছিল, না হলে এই আলোচনার এত বিস্তারিত ওয়াশিংটনে পাঠানো প্রতিবেদনে উল্লেখ থাকত না। কারণ ওই সময়টা যে মুখ্য বোস্টারকে নিশ্চয়ই তা প্রমাণ করার দরকার হয়ে পড়েছিল। এমনকি বঙ্গবন্ধু যে চীনের পরিবার ভেঙে দেয়া কৃষি সমবায়ী পদ্ধতি বাংলাদেশের জন্যে উপযুক্ত হবে না আর চীনাদের তিনি তা ১৯৫৭ সালেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, সে ব্যাখ্যা শুনে নিশ্চয়ই বোস্টার বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চিন্তা কতটা পরিপক্ব এটা ভেবে সে আলোচনার বিস্তারিত উল্লেখ করতে কোনো ভুল করেননি। চলবে...
নিউজটি আপডেট করেছেন : Banglar Jamin
কমেন্ট বক্স